শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৪ অপরাহ্ন

ইউক্রেন নিয়ে ফের উত্তপ্ত রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র

ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর পশ্চিমা সামরিক মিত্রদের বাদানুবাদ দিনকে দিন বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে। এই বাদানুবাদের বিস্ফোরণ দেখা গেছে বৃহস্পতিবার সুইডেনে ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ক এক বৈঠকেও।

স্টকহোমের বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন, রাশিয়া তার ঘরের পাশে ন্যাটো সামরিক জোটের নতুন কোনো তৎপরতা কোনোভাবেই সহ্য করবে না।

লেভরভ সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোট রুশ এই বার্তা অগ্রাহ্য করলে ইউরোপে আবারও যুদ্ধ শুরু হতে পারে। ইউরোপকে আবারও যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন দেখতে হতে পারেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুইডেনের বৈঠকে রাশিয়া ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে যার মূল কথা-ন্যাটো জোটকে ইউরোপের পূর্বে নতুন কোনো বিস্তৃতির চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

ব্লিনকেন রাশিয়ার সেই প্রস্তাব বা দাবির ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। বরং তিনি পাল্টা সতর্ক করেছেন যে, ইউক্রেনে কোনো সামরিক অভিযান চালালে রাশিয়াকে তার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।

২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল এবং ইউক্রেনের জাতিগত রুশ অধ্যুষিত ডনবাস অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে গত সাত বছর ধরে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা ন্যাটো জোটের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, এই টানাপড়েন দিনকে দিন বিপজ্জনক চেহারা নিচ্ছে।

সুইডেনে বৃহস্পতিবারের বৈঠকটি হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তে ৯০ হাজারেরও বেশি রুশ সৈন্য সমাবেশ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। জানা গেছে, বৈঠকটি বহু-দেশীয় হলেও আলাদাভাবে মুখোমুখি কথা বলেছেন লেভরভ এবং ব্লিনকেন।

মার্কিন কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দুপক্ষই ইউক্রেন নিয়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে একমত হয়েছে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে। তবে কবে তা হতে পারে তা নিয়ে কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি।

গত জুনে জেনেভাতে পুতিন এবং বাইডেনের মধ্যে মুখোমুখি যে বৈঠক হয়েছিল সেখানেও ইউক্রেন এবং ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে কথা হয়। কিন্তু তাতে যে কোনো ফল হয়নি তা রাশিয়ার নতুন এই সৈন্য সমাবেশের ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

রাশিয়া কয়েক বছর ধরে বিভিন্নভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে ইউক্রেনে আমেরিকা বা ন্যাটো জোটের কোনো সামরিক উপস্থিতি তারা মানবে না। সপ্তাহখানেক আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন আবারও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে হবে।

বৃহস্পতিবার স্টকহোমে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেভরভ খোলাখুলি বলেন, ইউক্রেন দিয়ে বিপজ্জনক কোনো পরিস্থিতি এড়ানোর কোনো সদিচ্ছা ন্যাটো দেখাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ন্যাটো জোটের সামরিক অবকাঠামো রাশিয়ার সীমান্তে নিয়ে আসা হচ্ছে। রোমানিয়া এবং পোল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা মোতায়েন করা হচ্ছে। আমেরিকার তৈরি মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইউরোপে নিয়ে আসা হচ্ছে। যার অর্থ ইউরোপে সামরিক সংঘাতের দুঃস্বপ্ন পুনরায় ফিরে আসছে।

লেভরভ হুঁশিয়ার করেন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা মিত্ররা যেন ইউক্রেনসহ রাশিয়ার প্রতিবেশীদেরকে সামরিক সংঘাতের চারণভূমি বানিয়ে না ফেলে।

যদিও ইউক্রেন এবং এর পশ্চিমা মিত্ররা ক্রমাগত বলছে, রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পাঁয়তারা করছে। তবে সিংহভাগ বিশ্লেষক এখনও মনে করছেন না যে, রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক কোনো অভিযান চালাবে।

ক্রেমলিন স্পষ্ট একটি বার্তা দিতে চাইছে যে, ইউক্রেনকে যেন কখনই ন্যাটো জোটের সদস্য না করা হয় এবং তাদের এই রেড লাইন ভাঙলে রাশিয়া তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত।

পুতিনের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করছেন ন্যাটোতে ঢোকার ব্যাপারে পশ্চিমারা ইউক্রেনের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আশা যোগাচ্ছে। মস্কোতে রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া এমন মন্তব্য করেছেন।

ন্যাটোর পক্ষ থেকে যেভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে পুতিন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, লাল কাপড় দেখলে ষাঁড় যেমন ক্ষেপে যায় পুতিনের অবস্থা অনেকটাই তেমন।পুতিন ভাবছেন এখনই যদি তিনি কিছু না করেন তাহলে ইউক্রেনে ন্যাটো ঘাঁটি হবে। সুতরাং এখনই তাকে এটা আটকাতে হবে।

ইউক্রেন যে ন্যাটোতে যোগ দিতে উদগ্রীব তা অজানা কিছু নয়। আর তার দোরগোড়ায় আরেকটি ন্যাটো দেশের উপস্থিতি যে রাশিয়া মানবে না, তাও নতুন কিছু নয়। কিন্তু রাশিয়া দেখছে যে, তাদের আপত্তির তোয়াক্কা না করে নেটো দেশগুলো থেকে ইউক্রেনে অস্ত্র যাচ্ছে।

পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য তুরস্কে তৈরি ড্রোন কিনেছে ইউক্রেন। ক্রাইমিয়ার কাছে আকাশে সম্প্রতি পারমাণবিক বোমা ফেলতে সক্ষম দুটো আমেরিকান যুদ্ধ বিমান উড়তে দেখার ঘটনায় মস্কো প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত।

সেই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কির সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যে রাশিয়া ক্ষিপ্ত। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রাইমিয়াকে মুক্ত করা তার সরকারের লক্ষ্য। ডনবাস অঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের দমনে বড় ধরণের সামরিক অভিযান চালানোর ইঙ্গিতও ইউক্রেন দিচ্ছে।

এসব কথাকে রাশিয়া উস্কানি হিসাবে দেখছে। মস্কো মনে করছে, পশ্চিমাদের ভরসায় ইউক্রেন এসব কথা বলার সাহস পাচ্ছে। ইউক্রেন সরকার এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সতর্ক করতেই যে, সীমান্তে এই সেনা সমাবেশ তা নিয়ে রাশিয়া রাখঢাক করছে না।

ইউক্রেন নিয়ে মস্কোতে গত সপ্তাহে রুশ কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে পুতিন বলেন, আমাদের হুঁশিয়ারিতে তারা যে কান দিচ্ছে তার লক্ষণ পরিষ্কার। কারণ তারা উত্তেজিত … পশ্চিমা দেশগুলো যেন রাশিয়ার কথা কানে দেয় তার জন্য উত্তেজনা অব্যাহত রাখতে হবে।

মস্কোর গবেষণা সংস্থা আইআইএসির গবেষক অন্দ্রেই কর্তুনভ বিবিসিকে বলেন, ইউক্রেনের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের অর্থ এই নয় যে, রাশিয়া সৈন্য ঢুকিয়ে দেবে। পুতিন আসলে একটি বার্তা দিতে চাইছেন, আর বার্তাটি হচ্ছে ইউক্রেনকে সতর্ক করা যে পশ্চিমাদের ভরসায় ডনবাস অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পথে তারা যেন পা না বাড়ায়।

নানাভাবে ইউক্রেনের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করছে রাশিয়া। গত সপ্তাহে রুশ গুপ্তচর সংস্থা এসভিআর ইউক্রেন সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার যুদ্ধের অবতারণা করেছে।

বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জাতিগত রুশ অধ্যুষিত দক্ষিণ ওসেটিয়া কব্জা করতে গিয়ে তৎকালীন জর্জিয়ান প্রেসিডেন্ট সাকাশভিলিকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছিল এসভিআর এর বিবৃতিতে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। জর্জিয়া ওসেটিয়া দখল করতে গেলে রাশিয়া সামরিক অভিযান চালিয়েছিল।

তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, জর্জিয়ার ফর্মুলা ক্রেমলিনের টেবিলে রয়েছে। ইউক্রেনের বেলাতেও তার প্রয়োগ হতেই পারে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, রাশিয়া তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি মনে করি যে একটি বিকল্প রয়েছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

কর্তুনভ বলেন, দরকার হলে রাশিয়া যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এমন একটি বার্তা পুতিন দিতে চাইছেন ঠিকই কিন্তু ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক অভিযান চালিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল হবে বলে তিনি মনে করেন না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মার্ক গ্যালিওটি মনে করেন, মস্কো হয়তো তার সব বিকল্প প্রস্তুত করছে কিন্তু সামরিক অভিযান নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেয়নি। তিনি বলেন, নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি এবং পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ করার ঝুঁকি হয়তো পুতিন এখন নিতে চাইবেন না।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ইউক্রেন সীমান্তে ট্যাংক আর সৈন্য পাঠিয়ে মস্কো যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকবার আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে চাইছে। পুতিন ও বাইডেনের সঙ্গে আরেকটি শীর্ষ বৈঠক চাইছে তারা।

বৃহস্পতিবার স্টকহোমের বৈঠকে তেমনি একটি শীর্ষ বৈঠক নিয়ে কথা হয়েছে। তবে তার কোনো নিশ্চয়তা যুক্তরাষ্ট্র দেয়নি। পুতিন হয়তো এখনও বিশ্বাস করেন যে, তিনি বাইডেনের সঙ্গে একটি বোঝাপড়া করতে পারবেন। কিন্তু তিনি যদি দেখেন তার কোনো আশাই নেই তাহলেই সম্ভাব্য বিপদ। পুতিন তখন এমন পথ নিতে পারেন যা ধারণা করা কঠিন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুক পেজ
ব্রেকিং নিউজ