শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৯ পূর্বাহ্ন

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে বিলাসবহুল লঞ্চ

যাত্রীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলো। অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সামগ্রী তাৎক্ষণিক দরকার তা রাখা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এছাড়া লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষের পাশে অরক্ষিত অবস্থায় ডিজেলভর্তি ব্যারেল রাখা, বড় গ্যাস সিলিন্ডার বসিয়ে রান্না করা, চা-সিগারেটের দোকান পরিচালিত হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। লঞ্চে আনসার বাহিনীর সদস্যদের অনুপস্থিতি ও সিসি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক মনিটরিং না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটলেও তা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগত হচ্ছে না। ছোট দুর্ঘটনার পাশাপাশি ঘটছে প্রাণহানি। প্রায়ই সাধারণ যাত্রীরা ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি, জাপিং পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। যাত্রীদের দাবি, এ নৌরুটে জীবন হাতে নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাই শতভাগ যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিতে লঞ্চগুলোতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন যাত্রীরা।

সরেজমিন দেখা গেছে, বরিশাল নৌবন্দরের পন্টুনে নোঙর করা সাতটি লঞ্চের মধ্যে অধিকাংশ লঞ্চের সব জায়গায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র টানানো নেই। ইঞ্জিনকক্ষগুলোতে কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র টানিয়ে দায় সেরেছেন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। কয়েকটি লঞ্চের দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলেও তা ছিল অপর্যাপ্ত। কোনো লঞ্চেই ডেক যাত্রীদের জন্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল না। ডেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ইঞ্জিনকক্ষে বা নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আনতে হবে। ততক্ষণে আগুন অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে। তাছাড়া লঞ্চগুলোতে আগুন নেভানোর জন্য মাত্র একটি হাতেচালিত পাম্প রয়েছে। কেবিন যাত্রীদের জন্য কোনো লাইফ জ্যাকেট বরাদ্দ নেই। ১৫-২০টি কেবিনের যাত্রীদের জন্য রয়েছে মাত্র ২-৩টা বয়া। ডেকের অবস্থাও একই। এর মধ্যেই বিশেষ দিনগুলোতে যাত্রীচাপ বেড়ে গেলেও লাইফজ্যাকেট বা বয়া সংখ্যা বাড়ানো হয় না। প্রত্যেক লঞ্চে নিয়ম অনুযায়ী লাইফ বয়া ২৫০টি, ফায়ার বাকেট ২৫টি, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ২৫টি ও একটি বালির বাক্স রয়েছে বলে দাবি লঞ্চ কর্তৃপক্ষের।

এছাড়া প্রতিটি লঞ্চে ইঞ্জিনকক্ষের পাশে বড় গ্যাস সিলিন্ডার রেখে খাবার হোটেলের রান্না কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তার পাশেই চলছে চা-সিগারেট বিক্রির দোকান। ইঞ্জিনকক্ষের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় ডিজেলভর্তি ব্যারেল। তাছাড়া পাশেই টয়লেট স্থাপন করায় মানুষ অবিরত যাতায়াত করছে। ফলে অরক্ষিত অবস্থায় থাকে লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষ।

এ নৌরুটে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ হাজার যাত্রী চলাচল করেন। এসব যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য অতীতে প্রত্যেক লঞ্চে ১১ জন করে সশস্ত্র আনসার বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করতেন। বর্তমানে এ রুটের কোনো লঞ্চেই আনসার সদস্য নেই। কারণ লঞ্চের মালিকরা ব্যয় কমাতে কৌশলে আনসার বাহিনীকে এড়িয়ে চলছেন। আনসার সদস্যের পরিবর্তে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে লাঠি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তাকর্মী। কারণ একজন আনসার সদস্যের বেতনের টাকা দিয়ে লঞ্চ মালিকরা চারজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিতে পারেন। তাই ব্যয় কমাতে যাত্রী নিরাপত্তার কথা ভুলে মাত্র তিন-চারজন নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। কিন্তু সেই নিরাপত্তাকর্মীরা যাত্রীদের নিরাপত্তা না দিয়ে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছেন। বেতন কম হওয়ায় লঞ্চের ডেকে চাদর দিয়ে জায়গা দখল করে বিক্রি করে টাকা আয় করছেন তারা। তাছাড়া পুরো লঞ্চে নিরাপত্তার জন্য কমপক্ষে ৪০টি ক্যামেরা স্থাপনের দরকার হলেও অধিকাংশ লঞ্চে রয়েছে মাত্র ১০-১২টি ক্যামেরা। যে ক্যামেরা আছে তাও সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয় না। এছাড়া প্রায়ই ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ার পর মুন্সীগঞ্জে পৌঁছানোর আগেই জাপিং পার্টির সদস্য যাত্রীদের মালামাল নিয়ে নদীতে লাফ দেয়। লঞ্চের যে অংশে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা নেই, সেই অংশেই অঘটন বেশি ঘটেছে। এছাড়া ঘটেছে একাধিক হত্যাকাণ্ড। সম্পূর্ণ লঞ্চ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে না থাকায় কোনো অঘটন ঘটলে তা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে বা বিলম্বে জানতে পারছেন। তাই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা।

এ রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী মিজানুর রহমান জানান, প্রায়ই ছিনতাই ও জাম্পিং পার্টির খপ্পরে পড়ে অনেকেই নিঃস্ব হচ্ছে। ঘটছে হত্যার ঘটনাও। জীবন হাতে নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাই আনসার নিয়োগের পাশাপাশি যাত্রীদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

বরিশাল সদর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসনাত জামান জানান, নৌপুলিশ টার্মিনালে লঞ্চ অবস্থানকালে যাত্রীদের নিরাপত্তায় কাজ করে। লঞ্চ নৌবন্দর ত্যাগ করার পর যাত্রী নিরাপত্তার দায়িত্ব লঞ্চ কর্তৃপক্ষের।

অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, যাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রতিটি লঞ্চে সিসি টিভি স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া আনসারদের বেতন বেশি হওয়ায় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তিন-চারজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। যাত্রীসেবা নিশ্চিতে লঞ্চ মালিকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল বন্দর ও পরিবহণ বিভাগের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, লঞ্চে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বিআইডব্লিউটিএ অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন লঞ্চ ছাড়ার আগে সার্ভে সনদ এবং নিবন্ধন হালনাগাদ আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক যাত্রী নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা ও লঞ্চ মালিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত নিরাপত্তাকর্মীদের কার্যক্রম তদারকি করছে বিআইডব্লিউটিএ। এ ছাড়া আনসার নিয়োগসহ যাত্রীদের দাবি পূরণে লঞ্চ মালিকদের নিয়ে সভা করে বিষয়গুলো জানানো হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুক পেজ
ব্রেকিং নিউজ