সয়াবিনের দাম একেক দোকানে একেক রকম। খুচরা বাজারে বৃহস্পতিবার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন কিনতে ক্রেতাকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে। অনেকেই আবার সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে ফিরে গেছেন। খোলা সয়াবিন তেল তো বাজার থেকে উধাও। ক্রেতারা বলছেন, ভাই আমরা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে গেছি। শক্ত হাতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, দেশে এখন বিপুল পরিমাণ তেল আছে। খোলা তেলও রয়েছে। কিন্তু বাজারে বিক্রেতারা খোলা তেল সরিয়ে রেখেছে। কে কোথায় সরিয়েছে, তার তথ্যপ্রমাণ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা দ্রুত অভিযান পরিচালনা করব। সেই মজুত করা খোলা তেল আমরা বাজারে সরবরাহ করব। পাশাপাশি অসাধুদের আইনের আওতায় আনব। সেক্ষেত্রে আমরা এবার জেলেও পাঠাব। ইতোমধ্যেই আমরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছি। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
বুধবার রাত থেকেই খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বৃহস্পতিবার খুচরা বাজারে গিয়ে একই চিত্র দেখা গেল। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন কিনতে ক্রেতাকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে। খোলা সয়াবিন তো মিলছেই না। চালের বাজারও বাড়তি। এক কেজি চাল কিনতে ক্রেতাকে ৫০-৭০ টাকা গুনতে হচ্ছে। ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি। চিনির কেজিও ৮০ টাকার উপরে। সরবরাহ ভালো থাকলেও পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতার খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা।
যে গরুর মাংস দেড় মাস আগেও ৬০০ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৬৬০ টাকায়। ক্রেতাকে বাধ্য হয়ে কম খেয়ে সমন্বয় করতে হচ্ছে। পরিবারের বাজেটেও করতে হচ্ছে কাটছাঁট। মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ নিদারুণ কষ্টে আছেন।
বৃহস্পতিবার সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্য মূল্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ দাম বেড়েছে, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনে ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ দাম বেড়েছে।
পাশাপাশি খোলা পামঅয়েল লিটার প্রতি ১৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ দাম বেড়েছে। পাম অয়েল সুপারে লিটারে দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পাশাপাশি মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চাল ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি আলু কিনতে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
গরুর মাংস কিনতে ক্রেতার ৩ দশমিক ৩৯ ও ব্রয়লার মুরগি কিনতে ক্রেতার ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ বেশি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি চিনি কেজি প্রতি ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ দাম বেড়েছে। খোলা সয়াবিন নিয়ে টিসিবির বাজার পণ্য মূল্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার তারা রাজধানীর খুচরা বাজারে খোলা তেল পায়নি। তাই তারা দামও উল্লেখ করতে পারেনি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বরাবর দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্যের দাম কমই বৃদ্ধি করে। রমজান আসার আগেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে মনিটরিংও আগেভাগেই করতে হবে। কঠোর তদারকির মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাড়তি দরে ক্রেতার হাসফাঁস অবস্থা। সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার কিছু পণ্যের দর কারসাজিতে বেড়েছে। আমাদের অনেক পণ্য আছে যা আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে হয়। সে সব পণ্যের দামও বেশি। তাই দাম কমাতে আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় পণ্যের মজুত অনেক। পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। অসাধু ব্যবসায়ীকে সুযোগ নিতে দেওয়া হবে না। সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান চালাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত, সরবরাহ এবং মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বোতলজাত সয়াবিন ১৯০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা এক মাস আগে ছিল ১৫০ ও ১৬৮ টাকা। প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৬৫ টাকা। ছোট দানার মসুর ডাল ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এক মাস আগে ছিল ১১০-১১৫ টাকা।
প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ২২-২৪ টাকা, এক মাস আগে ছিল ১৮ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৩০-৩৫ টাকা। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৮০-৮২ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৭৫-৭৮ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৬৫০-৬৬০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৬০০ টাকা। আর প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি মাসের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারে পণ্য কিনতে আসা সামসুল হক বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের অনেক দাম। কোনটা বাদ দিয়ে বাজার শেষ করব ভাবছি। দাম বাড়ায় কেনাকাটাও কমিয়ে দিয়েছি। বাজারে এলে কান্না পায়। কিন্তু প্রকাশ্যে কান্না করতেও পারি না। বোবা পশুর মতো কান্না করি।
রাজধানীর নয়াবাজারে পণ্য কিনতে আসা মো. ইসহাক বলেন, বাজারে এসে দেখি বিক্রেতারা ভোজ্যতেল বিক্রি করছে না। তারা বলছে নাই। তবে কয়েকটি দোকানে পাওয়া গেলেও একেক দোকানদার একেক দাম বলছে। বিক্রেতারা বলছেন, মিল থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বুঝমাল, তেল সরবরাহ বন্ধ। কিন্তু ১৭০ টাকা লিটারের তেল ১৯০-২০০ টাকা কি করে বিক্রি হয়? সরবরাহ কমানোয় খুচরা বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে অভিযান চলছে। মিলগুলোতেও অভিযান চালানো হবে। আমরা রুট লেভেলে চলে গেছি। কোথায় এর ম্যানিপুলেট হচ্ছে, ডিলার-মিলার, সাপ্লায়ার সবাইকে আমরা শনাক্ত করছি। ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। আশাকরি সুফল দেখা যাবে।
বরিশালে ২০০ টাকা লিটারেও মিলছে না ভোজ্যতেল : বরিশাল ব্যুরো জানায়, মূল্য বৃদ্ধির আশায় বরিশালে সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেলেও লিটার ২০০ টাকার নিচে মিলছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন স্টকে তেল নেই। তবে ক্রেতারা বলছেন অতি মুনাফার আশায় দোকানদাররা তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। মঙ্গল ও বুধবার বরিশাল নগরীর বাজার রোড, বাংলাবাজার, চৌমাথা বাজার ও নতুন বাজার ঘুরে সয়াবিন তেল না থাকার চিত্র দেখা যায়। দু-একটি দোকানে পাওয়া গেলেও ২-৩ বোতলের বেশি নয়।
সদর রোডের খাবার হোটেল ব্যবসায়ী মো. পারভেজ বলেন, প্রতিদিনের মতো আজও তেল কিনতে গিয়ে পড়েছি বিপাকে। সয়াবিন তেলের দাম যাই হোক হোটেল চালাতে তেল তো আমার লাগবে। তাই আমি পরিচিত দোকানিদের কাছ থেকে ৫ লিটারের একটি বোতল ৮৬৫ টাকায় নিয়েছি যা একদিন ছিল ৭৮০ টাকা।
ক্রেতা মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি দোকানে সয়াবিন তেল রয়েছে। ২০০ টাকা লিটার দরেও ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা তা মজুত করে রেখেছেন। আমি বহু দোকান ঘুরে ১৬০ টাকার লিটারের তেল ২০০ টাকা দরে কিনেছি। বাজার রোডের মুদি দোকানি শামসুর রহমান বলেন, দোকানে কোনো তেল নেই। কোম্পানি থেকেই সাপ্লাই নেই। আমরা বিক্রি করব কিভাবে। আমি কোনো তেল মজুত করিনি।
চৌমাথার ব্যবসায়ী মন্টু বলেন, তেল থাকলে তো বিক্রি করব। তেলই নেই। কিছু লাভের আশায় ক্রেতাদের ভোগান্তি করে তো লাভ নেই। নগরীর প্যারারা রোডের ব্যবসায়ী মো. মারুফ বলেন, এক লিটারের একটি এবং আধা লিটারের কয়েকটি বোতল রয়েছে আমার দোকানে। এগুলো সবই বিক্রি হয়ে গেছে, এক ব্যক্তি কিনে রেখে গেছে। এই বিষয়ে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রশান্ত কুমার দাস বলেন, দোকানিরা বাড়তি লাভের আশায় সয়াবিন তেল মজুদ করে রাখলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমাদের প্রতিদিন বাজার মনিটরিং কার্যক্রম চলমান আছে।