শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২১ অপরাহ্ন

১২ ঘণ্টায় বরিশাল টু চট্টগ্রাম ভ্রমণ

এদিন চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে একটি জাহাজ আসবে। এ নৌরুটে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জাহাজ চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সবকিছু ঠিক থাকলে যাত্রী ও পণ্যের ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু নির্ধারণ করা হবে।

নৌপরিবহণ করপোরেশনের (টিসি) কর্মকর্তারা জানান, জাহাজ চালুর মাধ্যমে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। জাহাজে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে আসতে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এ রুটে পুনরায় জাহাজ চালুর এ উদ্যোগের খবরে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও খুশি। সার্ভিসটি চালু হলে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম যেতে বর্তমানে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তার অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করেন সবাই।

বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) আশিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে ৪ দিন আমরা জাহাজ চালানোর উদ্যোগ নিয়েছি। নির্ধারণ করা জাহাজ দুটির এ রুটে ১২ নট গতিতে চলার সক্ষমতা রয়েছে। এ হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে যেতে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৭টায় ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই বরিশালে পৌঁছানো যাবে। ২৫ নভেম্বর এ রুটে ট্রায়াল রান হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ভাড়া নির্ধারণ শেষে আগামী মাস থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ শুরু হবে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে আসার পথে হাতিয়া-সন্দ্বীপ-নোয়াখালী এবং ভোলার ইলিশায় থামবে জাহাজ। তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাশাপাশি প্রতিটি জাহাজে ২৫টি কেবিনসহ ৭৫০টি আসন রয়েছে।

এ নৌরুটে জাহাজ পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন টিসির রুস্তুম আলী বলেন, বরিশাল থেকে ছেড়ে ভোলার ইলিশা পার হয়ে বামে মনপুরা আর ডানে বোরহানউদ্দিনের মির্জাকালু রেখে বঙ্গোপসাগরে নামবে জাহাজ। এরপর চট্টগ্রামের কর্ণফুল নদীতে ঢোকার আগ পর্যন্ত পুরোটাই সমুদ্রপথ। আগে যখন জাহাজ চালিয়েছি তখন দেখতাম শুধু এ সমুদ্র পথটুকু ভ্রমণের আনন্দ নিতে বহু মানুষ জাহাজে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম যেতেন। তখন অবশ্য বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম যেতে ২০-২১ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন ১২ ঘণ্টায় যাওয়া গেলে অবশ্যই যাত্রীদের আগ্রহ আরও বাড়বে।

বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটে পুনরায় জাহাজ চালুর উদ্যোগে খুশি এখানকার সাধারণ মানুষসহ ব্যবসায়ী নেতারাও। বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, সার্ভিসটি চালু হলে ভ্রমণপিপাসু মানুষের যেমন উপকার হবে তেমনি বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বর্তমানে যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তারও অবসান ঘটবে। ছেলেমেয়ে আর লাগেজপত্র নিয়ে বারবার বাস-লঞ্চ-ফেরি পালটে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যে কতটা কষ্টের তা যারা না গেছেন তারা বুঝবেন না। জাহাজে ১২ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম যাওয়া গেলে পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে যাওয়ার ক্ষেত্রও সহজ হবে।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সদর উপজেলার চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে এক সময় এ নৌ সার্ভিসটিই ছিল একমাত্র ভরসা। ২০০৯ সালে এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে দুর্ভোগে আছি আমরা। সড়কপথে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতায় পড়তে হয়। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হওয়ার পাশাপাশি সময়ও লাগছে বেশি। ১২ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করতে পারলে আমাদের সময় ও আর্থিক সাশ্রয় দুটিই হবে।

বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের উপকূলীয় সার্ভিসটি ছিল বহু বছরের পুরনো একটি ঐতিহ্যবাহী নৌরুট। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে বরিশালে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজের চলাচল শুরু হয়। পরে অবশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে রুটটি ঘুরিয়ে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া বরিশাল পথে আনা হয়।

পশ্চিম জার্মানি থেকে আনা চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ দিয়ে রুটটি তখন চালু ছিল। বরিশাল তথা সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে চট্টগ্রামের নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ রুটে জাহাজ চলে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষও পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল এ উপকূলীয় সার্ভিসের ওপর।

১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে নৌপরিবহণ করপোরেশন এ রুটের জাহাজ এমভি তাজুল ইসলামকে বিক্রি করে দেয়। বাকি তিনটি জাহাজ এমভি মতিন, এমভি মনিরুল হক এবং এমভি আলাউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে সার্ভিসটি চলতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে এমভি আলাউদ্দিন আহম্মেদকে পরিত্যক্ত ঘোষণা ও বিক্রি করে দেওয়া হয়। জাহাজ সংকটে সপ্তাহে মাত্র দুদিনে সার্ভিসটি নেমে আসে। ২০০৯ সালে মেরামতের কথা বলে এমভি মতিন ও এমভি মনিরুল হককে ডকে তোলা হয়। একইসঙ্গে বরিশাল-চট্টগ্রাম নৌরুট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অভিযোগ- ডকে যাওয়া এমভি মতিন ও এমভি মনিরুল হক জাহাজে নতুন ইঞ্জিন বসানো হলেও গিয়ার বক্সের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় তা আর চালানো যায়নি। এরই মাঝে ৩০ কোটি টাকা গচ্চাও গেছে। বর্তমানে জাহাজ দুটিকে স্ক্র্যাপ ঘোষণা করে বিক্রির অপেক্ষায় রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

২০০৯ সালে বরিশাল-চট্টগ্রাম নৌরুট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগে বিপাকে পড়েন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। কারণ যে তিনটি রুটে বর্তমানে বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে যেতে হচ্ছে সেগুলোর সবই সময়-সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বরিশাল কিংবা ভোলার ইলিশা থেকে মেঘনা পাড়ি দিয়ে লক্ষ্মীপুর হয়ে চট্টগ্রাম যেতে একদিকে যেমন লাগছে অনেক সময় তেমনি অর্থ ব্যয়ও হচ্ছে প্রচুর।

এছাড়া বারবার লঞ্চ-বাস আর ফেরি পালটানোর কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বরিশাল থেকে চাঁদপুর-ঢাকা কিংবা শরীয়তপুর-হরিণা ফেরি পার হয়ে যেতেও লাগছে প্রায় দেড় থেকে দুদিন। এসব রুটে সরাসরি যাতায়াতের তেমন কোনো সার্ভিস না থাকায়ও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় বহু আগে থেকেই দাবি ছিল-চট্টগ্রাম-বরিশাল নৌরুট পুনরায় চালু করার। আর সেটাই করতে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিসি।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী-এ রুটে চলাচলের জন্য দুটি জাহাজ প্রস্তুত করা হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম-হাতিয়া রুটে চলাচলকারী এমভি তাজউদ্দীন বরিশাল পর্যন্ত যাবে। এছাড়া সদ্য সংস্কার কাজ শেষে ডকইয়ার্ড থেকে আসা এমভি বারো আউলিয়াও এ রুটে যুক্ত হবে। ২০০২ সালে নির্মিত জাহাজ বারো আউলিয়ার বিকল একটি ইঞ্জিন পালটে নতুন ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থ্রি-অ্যাঙ্গেল ডকইয়ার্ডে নতুন ইঞ্জিন লাগানো শেষে এটিও এখন প্রস্তুত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুক পেজ
ব্রেকিং নিউজ