শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:০২ পূর্বাহ্ন

নগদ উত্তোলনের টাকা গেল কোথায়?

করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বেশকিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের জালিয়াতি করেছে। তারা ঋণের মোটা অঙ্কের অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়েছে। এসব অর্থ কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, এর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ওইসব অর্থ সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, এ বিষয়েও কোনো তথ্যপ্রমাণ দেখাতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এদিকে নগদ টাকার গন্তব্য সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জোরালো কোনো তদন্ত হচ্ছে না। ফলে প্রণোদনার জালিয়াতির পুরো চিত্র উঠে আসছে না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলেছেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল। এর শর্তও ছিল এ অর্থ শুধু সংশ্লিষ্ট শিল্পের চলতি মূলধন হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এ শর্ত ভঙ্গ করে যেসব ব্যাংক ঋণ দিয়েছে এবং যারা অন্য খাতে নিয়েছে-দুই পক্ষেরই শাস্তি হওয়া উচিত। একই সঙ্গে নগদ যেসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে সেগুলো কোথায় কীভাবে স্থানান্তর হয়েছে, তা তদন্ত হওয়া উচিত। অন্তত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব প্রয়োজনে টাকা লেয়ারিংয়ের (নামে-বেনামে স্থানান্তর) ধরন সম্পর্কে ধারণা নিতে এগুলোর বিশদ খতিয়ে দেখা উচিত।

সূত্র জানায়, প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহারকারীদের খুঁজে বের করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ৮টি পরিদর্শন বিভাগ ও ঢাকার বাইরের ৮টি শাখা অফিস থেকে প্রায় সব ব্যাংকের বড় বড় শাখায় তদন্ত হয়েছে। পরিদর্শন বিভাগগুলো হচ্ছে ১ থেকে ৮ এবং শাখা অফিসগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট। প্রায় সব পরিদর্শককে দিয়ে এ কাজ হলেও প্রণোদনার অর্থ জালিয়াতির শুধু ব্যাংকিং অংশটুকু তদন্তে উঠে এসেছে। নগদ অর্থ গ্রাহকরা কোথায় নিয়ে গেছে, কী কাজে সেগুলো ব্যবহার হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, জরুরি ভিত্তিতে এসব তদন্ত হচ্ছে বলে নগদ উত্তোলনের গন্তব্য খুঁজে বের করা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। কেননা হাতে সে সময় নেই।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ ব্যাপারে নিবিড় অনুসন্ধান প্রয়োজন। কেননা নগদ আকারে অর্থ তুলে নিয়ে সেগুলা ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রায় সব লেনদেনই ব্যাংকিং চ্যানেলে হয়। বৈদেশিক এলসি, স্থানীয় এলসি, বড় অঙ্কের কেনাকাটা, কর্মীদের ২৫ হাজারের বেশি বেতনের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এর বাইরে ছোট ছোট কিছু বিষয় নগদ আকারে করা হয়। কিন্তু প্রণোদনার ঋণের মধ্যে বড় অঙ্কের টাকা নগদ আকারে তোলা হয়েছে। এর একটি অংশ শেয়ারবাজারেও গেছে। কিছু টাকা ভোগবিলাসেও খরচ হতে পারে। দেশের বাইরেও যেতে পারে। সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, প্রণোদনার ঋণ যদি সঠিক খাতে ব্যবহার না হয়ে থাকে, তাহলে এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর অপব্যবহারের ধরন বিশদভাবে ক্ষতিয়ে দেখলে টাকার লেয়ারিং সম্পর্কে জানতে পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই লাভবান হবে। কিছু নজির তাদের কাছে থাকবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রণোদনার ঋণের অর্থের অপব্যবহারের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হচ্ছে। এ কারণে দ্রুত প্রতিবেদন তৈরি করে সেগুলো পাঠানো হচ্ছে। প্রণোদনার নীতিমালা অনুযায়ী সুদ বাবদ সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ভর্তুকি হিসাবে জোগান দেওয়া হচ্ছে। যারা ঋণ নিয়ে অপব্যবহার করেছেন, তারা সুদ ভর্তুকি পাবেন না। সেক্ষেত্রে ৯ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব গ্রাহকের ব্যাপারে অর্থ অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কোনো একক হিসাব থেকে একদিনে ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ নগদ আকারে তোলা হলে ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) বা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন হিসাবে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে (বিএফআইইউ) জানাতে হয়। প্রণোদনার ঋণ ছাড় হওয়ার পর ১০ লাখের বেশি অর্থ একসঙ্গে অনেক গ্রাহক নগদ আকারে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু অনেক ব্যাংক এ বিষয়ে বিএফআইইউতে প্রতিবেদন পাঠায়নি। এটি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ। বিএফআইইউ থেকে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

একটি সরকারি ব্যাংক থেকে বড় একটি শিল্পগ্রুপ ২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১১ কোটি টাকা প্রথমে একটি সরকারি ব্যাংকের কাওরান বাজার শাখায় একই গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করে। পরে তা ওই শাখা থেকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় স্থানান্তর করে। ওখান থেকে নেওয়া হয় এলিফেন্ট রোডে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখায়। ওই শাখা থেকে নগদ আকারে তুলে নেওয়া হয়। ওইদিনই ওই শাখা থেকে ১১ কোটি টাকার তিনটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। তবে এগুলো প্রণোদনার টাকা কি না, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর বিশদ তদন্ত করেনি। এভাবে প্রণোদনার টাকা নগদ আকারে তুলে নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পণোদনার টাকা নগদ আকারে তুলে নিয়ে পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে।

সিলমু ইলেকট্রোস লিমিটেড প্রণোদনার ঋণ নিয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কয়েকটি ব্যাংকের শাখা ঘুরিয়ে ওই টাকা গ্রাহক নগদ আকারে তুলে নেয়। পরে ওই অর্থ নিয়ে গ্রাহকের অন্য একটি ঋণ শোধ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে (বিএফআইইউ) ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ নগদ তোলার বিষয়ে সিটিআর প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ওই ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট লোকজন জড়িত। গ্রাহককে প্রণোদনার ঋণ দেওয়াই হয়েছে আগের ঋণ শোধ করার জন্য। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যাতে ধরা না পড়ে, সেজন্য তারা নগদ আকারে টাকা তুলে নিয়ে অন্যত্র স্থানান্তর করেছে। সেই অর্থ তুলে নিয়ে ঋণ শোধ করেছে।

বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম প্রণোদনা বাবদ ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা নগদ আকারে তুলেছে। পরে সেগুলো ১ কোটি টাকা করে ৩টি পে-অর্ডার করেছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। সেগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে জমা করেছে। পরে ওইসব অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়েছে। কিন্তু ওখান থেকে ওইসব টাকা কোথায় গেছে, এর হদিস পাওয়া যায়নি। এছাড়াও গ্রাহক ঋণের আরও ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা তারা নগদ তুলে নিয়েছে। এ অর্থও শিল্পের চলতি মূলধন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে কি না, ব্যাংক এর নিশ্চিত কোনো প্রমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকদের দেখাতে পারেনি।

রশিদ ব্রিকস ৮ কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ নিয়ে ১ কোটি টাকা নগদ তুলে নিয়েছে। এসব টাকা কোথায় নিয়েছে, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হদিস পায়নি।

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের তদন্তে দেখা যায়, প্রণোদনার ঋণের অর্থের একটি অংশ নগদ আকারে তুলে নিয়েছে। কিন্তু সেসব অর্থ কোথায় গেছে, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি আড়ত খাতুনগঞ্জে নগদ অর্থের লেনদেন বেড়েছে। খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের অর্থ লেনদেন শেষে ব্যাংকে জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, নগদ তুলে নেওয়া টাকার একটি অংশ খাতুনগঞ্জে পণ্য কেনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। যে কারণে ওখান থেকে ব্যাংকে অর্থ জমার পরিমাণ বেড়েছে। এর মাধ্যমে খাতুনগঞ্জে পণ্যের অবৈধ মজুত গড়ে উঠতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একইভাবে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা থেকে প্রণোদনার অর্থ নগদ আকারে তুলে নেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে দেখা গেছে বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। কেননা অনেকে প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অটো রাইস মিলের আগের ঋণ শোধ করেছেন। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ শোধ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু অর্থ দিয়ে বেশি মুনাফার আশায় ধান কিনে মজুত করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে মনে করা হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি বিশদ তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুক পেজ
ব্রেকিং নিউজ